জেন জি স্যোশাল মিডিয়া ট্রেন্ড ২০২৪
মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে জেনারেশন জেড-এর মন জয় করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। আপনার ব্র্যান্ডের টার্গেট গ্রুপ যদি জেন জি হয়, তাহলে এই ব্লগটি মূলত আপনার জন্যই। ব্লগটি ইংরেজিতে পড়তে ক্লিক করুন।
বর্তমান বাংলাদেশের দেশের সবচেয়ে বড় জেনারেশন হলো জেন-জি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৮ শতাংশ । ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্ম নিয়েছে – এরাই হলো জেনারেশন জুমার বা সংক্ষেপে ’জেন জি’। জেনারেশন জুমারের বিশেষত্ব হচ্ছে, জন্ম থেকেই এরা প্রযুক্তির সাথে বড় হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে জেন জি’র আচরণ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় এবং এই আচরণের প্রভাব পুরো বিশ্বের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গণে পরিবর্তন এনেছে।
ফোনকল রিসিভ করে না
ফোন রিসিভ না করার প্রবণতা প্রথম দেখা গিয়েছিলো মিলেনিয়ালদের মধ্যে। জেন জি’র মধ্যে এই প্রবণতা আরও বেশি। ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী প্রায় ২০০০ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৭০% এর বেশি ফোনে কথা বলার চেয়ে টেক্সট করা পছন্দ করে এবং এদের প্রায় এক চতুর্থাংশ ফোন কল এভয়েড করে।
সরাসরি ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যেই এক ধরণের এংজাইটি বা অস্বস্তি কাজ করে। এই এংজাইটি বা অস্বস্তিকে বলা হয় ’টেলিফোনফোবিয়া’। ফোনে অনেক অপ্রীতিকর খবর আসে, এবং অপ্রয়োজনীয় কল ব্যস্ততায় ব্যাঘাত ঘটায়, যা জেন জি’দের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে। সাইকোলজিস্ট এলেনা টারনি মন্তব্য করেছেন যে, ফোনে সরাসরি কথা বলার সময় যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়, সেটা এড়াতেই মূলত এই প্রজন্ম মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখে।
জেন জি’দের ফোন ধরার অজুহাত
এলয়েস স্কিনার নামের আরেক সাইকোলজিস্ট মনে করেন, প্রতিনিয়ত আরও বেশি ব্যাস্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কারণেই জুমাররা ফোন ধরার মতো সময় কম খুঁজে পায়। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলে স্ক্যাম ভেবে না রিসিভ করাও এই প্রজন্মের একটা অভ্যাস। এছাড়া জুমাররা গ্রুফ চ্যাট এবং ম্যাসেজে যোগাযোগ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
জেন জি ডিজিটাল প্রভাবিত
মিলেনিয়ালদের প্রথম দিককার সদস্যরা ব্যক্তিগত ফোন হাতে পেয়েছে, যখন তাদের বয়স গড়ে ২০বছর। আর জেন জি’রা গড়ে ১২ বছর বয়সেই ব্যাক্তিগত ফোন হাতে পেয়েছে। বর্তমান বিশ্বে জেন জি’দের বলা হয় প্রকৃত ‘ডিজিটাল ন্যাটিভ’। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, জুমারদের ৯৫% স্মাটফোন ব্যবহার করে, ৮৩ শতাংশের ল্যাপটপ আছে এবং ৭৮ শতাংশের ইন্টারনেটে গেমিং করে। এক্স-বক্স গেম ২০১৯ সালে ইউজারদের জন্য নেটফ্লিক্সের মতো সাবস্ক্রিপশন সুবিধা চালু করলে পরবর্তী ৫ বছরে এর পপুলারিটি প্রায় ৪৭৫% বেড়ে যায়।
এক্স-বক্স গেম প্রেস’ পপুলারিটি
জুমাররা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আর টিকটক। এক চতুর্থাংশ জুমার দিনে প্রায় ৫ ঘন্টার বেশি সামাজিক মাধ্যমে ব্যায় করে। এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৫০% জুমার মানিব্যাগ ছাড়া বের হলে যে পরিমাণ অনিরাপদ বোধ করে, স্মার্টফোন ছাড়া বের হলে তারচেয়ে বেশি অনিরাপদ বোধ করে।
২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিলো প্রায় ৬৬৭৬৬১০০ জন, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৭.৬%। ফেসবুক ব্যবহারীদের মধ্যে সবচেয় বড় গ্রুফ হলো জেন জি, যার সংখ্যা প্রায় ৩২৯০০০০০। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফেসবুক হলো বর্তমান বাংলাদেশে ব্যবহারকারী সর্বোচ্চ সামাজিক মাধ্যম।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে পুরো বিশ্বে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে টিকটক, যার ব্যবহার গত ৫ বছরে বেড়েছে প্রায় ৯১১%। ইউটিউব টিভির সার্চও গত ৫ বছরে বেড়েছে প্রায় ১৭৭%। তবে জুমাররা যে শুধু সামাজিক মাধ্যমই ব্যবহার করে, তা নয়। তারা ভিডিও স্ট্রিমিং, গেমিং এবং পডকাস্ট নিয়েও বেশ ব্যস্ত থাকে। জুমাররা প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৩ ঘন্টা ৪০ মিনিট সময় ব্যায় করে শুধু ভিডিও স্ট্রিমিং করে।
অর্গানাইজেশনের প্রতি অবিশ্বস্ততা
২০২০ সালে বাংলাদেশের মিলেনিয়াল এবং জুমার – এই দুই প্রজন্ম মিলে ছিলো দেশটির মোট ভোটারের ৩৭%। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট ভোটারের ৪৪%। দেশের যাবতীয় সমস্যার যথার্থ সমাধানে সরকার আরও বেশি পদক্ষেপ নিতে পারে বলে অন্তত ৭০% জেন জি মনে করে” – এমন রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ করেছে আমেরিকান গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ।
আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ”কোভিজ১৯ পরবর্তী সময়ে দেশের সুরক্ষায় সরকার তার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে” বলে মানতে নারাজ অন্তত ৬৬% জেন জি। একই গবেষণায় দেখা যায় যে, সরকারের উপর বিশ্বাস রাখাটা কঠিন বলে অন্তত ৬০% জেন জি মনে করে। এই প্রজন্মের প্রথম দিকের সদস্যরা নির্বাচন এবং রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি বিশ্বাস রাখতে নারাজ জুমারদের এই অনাস্থা সরকার ও রাজনীতির মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ নয়। ব্যাক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা বিবেচনায় এই প্রজন্ম ব্র্যান্ডের প্রতিও অনাস্থা পোষণ করে। এক জরীপে দেখা যায়, ব্যাক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার প্রশ্নে জেন জি’দের প্রায় ৬১% কোন ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা রাখতে নারাজ। ব্র্যান্ডের প্রতি এত অনাস্থা আগের কোন জেনারেশনে দেখা যায় নি। বৃটিশ কোম্পানি ডিলইটে ৪৪ দেশের প্রায় ২৩ হাজার মানুষের উপর জরীপ চালিয়ে দেখেছে যে, জেন জি’দের ৪৯% ধর্মীয় নেতাদের প্রতি, ৩০% ট্রেডিশন্যাল মিডিয়ার প্রতি, এবং ২৪% ব্যবসায়িক নেতাদের প্রতি অনাস্থা রাখে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অনাস্থা জুমারদের চরিত্রেরই একটা অংশ। সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি এই অনাস্থা নিয়েই জুমাররা বড় হবে। অর্গানাইজেশনের প্রতি আস্থা প্রত্যেকটা প্রজন্মেই কিছুটা কমেছে। তবে এই আস্থা জেন জি’দের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্যহারে হ্রাস পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মিডিয়া বিশেষজ্ঞ পিটার অ্যডাম।
বৈচিত্র্যময় এবং গ্রহণযোগ্যতাসম্পন্ন
সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় ২৮% জুমার। এই প্রজন্ম আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির প্রতি খুব সহনশীল এবং দুর্যোগকালীন সময়ে এরা সহায়তার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসে। সংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সাপোর্ট করার ক্ষেত্রেও জুমাররা অন্যান্য জেনারেশনের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণ ও গোত্রভিত্তিক জনসংখ্যার বিভাজন
ধর্ম ও সামাজিক বৈচিত্র্যতাকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে জেন জি সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত স্থাপণ করেছে। শ্রেণি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম সকলের প্রতিই তাদের গ্রহযোগ্যতা রয়েছে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টে দেখা যায়, জেন জি বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দেয় এবং বৈচিত্র্যময় ব্র্যান্ডকে তুলনামূলক বেশি ভ্যালু দেয়। সুতরাং ব্যবসায়ের সাথে জেন জি’দের যুক্ত করতে ব্র্যান্ডগুলোকে আরও বৈচিত্র্যময় বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেছে বিখ্যাত এই ম্যাগাজিন।
সবচেয়ে বড় ক্রেতাশ্রেণি
বর্তমানে জেন জি সবচেয়ে বড় ক্রেতাশ্রেণি। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য ক্রয় করে এই প্রজন্ম। ফলে পুরনো অর্থনৈতিক বিনিময় প্রথার পরিবর্তে নানা রকমের নতুন বিনিময় প্রথা বা সিস্টেম চালু হচ্ছে। এর মধ্যে বর্তমানের সবচেয়ে পপুলার সিস্টেম হলো বিএনপিএল বা ‘বাই নাউ, পে লেটার’ (এখন কিনুন, পরে পেরিশোধ করুন) সিস্টেম। মার্কেটিং বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায় যে, ১৪ বছরের চেয়ে বেশী বয়সের প্রায় ৪৪% জেন জি বিএনপিএল সিস্টেমে পণ্য ক্রয় করে। গত পাঁছ বছরে এই লেনদেন প্রক্রিয়ার ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৬গুণ।
অনলাইনে পণ্য ক্রয় করার ক্ষেত্রেও মিলেনিয়ালদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে জেন জি। তারা ব্র্যান্ডের পছন্দ অনুযায়ী নিজের পছন্দ তৈরি করে না। বরং নিজের পছন্দ আর চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়েই কোন ব্র্যান্ডকে পছন্দের তালিকায় যোগ করে। কারণ এই প্রজন্মের অন্য বৈশিষ্টই হলো স্বাতন্ত্র্য, ব্যাক্তিত্ব এবং নিজের মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেয়া। এছাড়াও জুমাররা পরিবার বা বন্ধুদেরকে নিয়মিত হারে নিজ পছন্দের কোম্পানি, প্রোডাক্ট এবং ব্র্যান্ড সাজেস্ট করে।
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতন
ডিলইটে’র এক জরীপে দেখা যায়, জেন জি’র প্রায় অর্ধেকে সদস্যই নানা প্রকার মানসিক চাপ ও এংজাইটিতে ভোগে। যুক্তরাষ্টভিত্তিক কোম্পানি ম্যাককিনসে’র রিপোর্টে দেখা যায়, জীবন সম্পর্কে সবচেয়ে হতাশাজনক ধারণা এবং আত্মহত্যার মতো মানসিকতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় জুমারদের মধ্যেই। বিশেষ করে, একাকীত্বে ভোগা এবং মানসিক সাপোর্ট কম পাওয়ার কারণে কোভিড পরবর্তী সময়ে জুমারদের মানসিক ম্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সমস্যা কমানোর উদ্দেশ্যেই সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক প্রচার বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে ‘ডিজিটাল ওয়েলবিয়িং’ – এর সার্চ ভলিউম বেড়েছে প্রায় ৬৩০০%। অর্থাৎ কোভিড মহামারীকালীন জেন জি’রা যে পরিমান মানসিক স্বাস্থ্যহীনতার সম্মুখীন হয়েছে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সচেতনতাবোধ বেশ বেড়েছে।
শেষকথা
বৈশ্বিক সংযোগ, বৈচিত্র্যতা এবং জোর মত প্রকাশের দিক থেকে পূর্বের সব প্রজন্মকে ছাড়িয়ে গিয়েছে জেন জি। বাস্তবের চেয়ে সামাজিক মাধ্যমে এই প্রজন্মের কর্মকান্ড বেশি প্রত্যক্ষ্য করা যায়। যথাযথ গবেষণা ও বিশ্লেষণ ব্যাতিত এই প্রজন্মের মানসিকতা সম্পূর্ণ বোঝা যে কোন ব্র্যান্ড বা অর্গানাইজেশনের জন্যই অবশ্যই দুরূহ। কিন্তু সচেতনভাবে এই প্রজন্মকে প্রমোট করতে পারলে ব্যবসায় ও বিশ্ব – দুটোরই কল্যাণ হবে। কারণ আগামী দিনের ব্যবসায় ও বিশ্ব – দুটোই নিয়ন্ত্রণ করবে স্পষ্টবাদী এই সাহসী প্রজন্ম।